
জগৎবিখ্যাত মাইম শিল্পী মার্শাল মারচুকে বলা হয় মাস্টার অফ সাইলেন্স, অর্থাৎ নীরবতার অধিপতি। কোনো শব্দ উচ্চারণ না করেই জীবনের গল্প বলে গিয়েছেন তার সুনিপুণ মূকাভিনয়ের মাধ্যমে। নীরবতার ভাষায় গল্প বলে মানুষকে হাসিয়েছেন-কাঁদিয়েছেন এই ফরাসি মূকাভিনেতা। জীবনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে তিনি তৈরি করেছেন অনন্য মাইম চরিত্র ‘দি বিপ’। বিপ হচ্ছে জীবনে আশার আলোময় একটি চরিত্র। এই চরিত্রে অভিনয় করেই তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন খ্যাতির অনন্য চূড়ায়। পৃথিবীর যেকোনো মূকাভিনেতার স্বপ্ন ছিল মার্শাল মারচুর সান্নিধ্য লাভ। পৃথিবীর যেকোনো মূকাভিনেতাই তাকে বিনা বাক্যব্যয়ে গুরু মানতে রাজি হয়ে যেতেন। বিশ্ববিখ্যাত বাংলাদেশি মূকাভিনেতা পার্থ প্রতিম মজুমদার ছিলেন মার্শাল মারচুর খুবই স্নেহভাজন ছাত্র।

পার্থ প্রতিম মজুমদার এবং তাঁর গুরু মার্শাল মারচু; Image Source: fb/mimePartha
চাচাতো ভাই জর্জ লঞ্জারই মার্শাল মারচুকে জার্মানদের বিরুদ্ধে ফরাসি প্রতিরোধ কার্যক্রমে নিয়োজিত করেছিলেন। লঞ্জার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসি ইহুদি শিশুদেরকে জার্মানদের হাত থেকে বাঁচানোর একটি গোপন ইউনিটের কমান্ডার ছিলেন। সেই সুবাদেই জার্মানরা যখন ফ্রান্সের দখল নিয়ে নিচ্ছিল, লঞ্জার তার ভাই মার্শাল মারচুকে নিয়ে ইহুদি শিশুদেরকে জার্মানদের আক্রমণ থেকে মুক্ত কোনো দেশে পাঠিয়ে দেয়ার অভিযানে নেমেছিলেন। প্রায় ৩৫০ জন ইহুদি শিশুকে মৃত্যুর হাত থেকে মুক্ত করে আনার কৃতিত্ব নিয়ে লঞ্জার গত ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ সালে ১০৮ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শেষ বয়সে মারচুর চাচাতো ভাই জর্জ লঞ্জার; Image Source: The Independent UK
তখন থেকেই মারচু বুঝতে পেয়েছিলেন, বেঁচে থাকার জন্য তাকে লড়াই করে যেতে হবে। বলে রাখা ভাল, মার্শাল মারচুর আসল নাম ছিল মার্শাল ম্যাঞ্জেল। কিন্তু জার্মান বাহিনীর কাছে ফরাসি সেনাদের আত্মসমর্পণের পর তিনি তাঁর নাম পরিবর্তন করে মার্শাল মারচু রেখেছিলেন। মারচু হচ্ছে ফরাসি বিপ্লব ফ্র্যাঙ্কো সেভেরিন মারসাউ-ডেসগ্রাভিয়ার এর সাধারণ রূপ।
মার্শালের সাথে সাথে তাঁর চাচাতো ভাইও নাম পরিবর্তন করে নম দু গেরে রেখে পরিচয় গোপন করে কোনোমতে জার্মানদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁর ইংরেজি এবং জার্মানসহ স্থানীয় ফরাসি ভাষায় পারদর্শিতা এবং ভাই মারচুর মূকাভিনয়; সব মিলিয়ে ফরাসি প্রতিরোধে বিভিন্ন অভিযান পার হয়ে যেতে তাদেরকে সাহায্য করেছিল।
জাল কাগজপত্র এবং নকল নাম নিয়ে তারা যুদ্ধকালীন সময়ে গেস্তাপো ডিটেকশন এড়িয়ে চলাফেরা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালে যুদ্ধ যখন এর সবচাইতে তিক্ত সমাপ্তির দিকে এগোচ্ছিল, জার্মানরা খুব তাড়াহুড়া করেই ফ্রান্সের অবশিষ্ট ইহুদি জনগণকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মিশনে নেমেছিল।

কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নেয়ার পথে পুলিশের হাতে ধরা পড়া ফরাসি শিশু; Image Source: Antoine GYORI/Sygma/Getty Images
তখন প্যারিসের একটি শিশু আশ্রমে কয়েকশ ইহুদি শিশু বাস করতো। তাদেরকে সেই আশ্রম বা এতিমখানা থেকে সরিয়ে আনাই ছিল ফরাসি প্রতিরোধ কার্যক্রমের প্রথম কাজ। আর এই কাজটি দেয়া হয়েছিল মূকাভিনেতা মার্শাল মারচুকে। তাকে বলা হয়েছিল যেকোনো মূল্যে যেকোনোভাবেই হোক না কেন,এই শিশুদেরকে এতিমখানা থেকে বের করে আনতেই হবে। তবে কোনোভাবেই নাৎসি কর্তৃপক্ষকে তা বুঝতে দেয়া যাবে না।
কারণ সারা ফ্রান্স তখন নাৎসিদের পদধ্বনিতে মুখোর। একটু ভুল হলেই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় তো আছেই, সাথে আছে জীবন হারানোর ভয়। উপায় না দেখে তিনি একজন স্কাউটের ছদ্মবেশ ধারণ করেন। এতিমখানার স্টাফদের কাছে তিনি নিজেকে স্কাউট পরিচয় দিয়ে আশ্বস্ত করেছিলেন এবং বলেছিলেন, বাচ্চাদেরকে ফরাসি স্কাউটের অধীনে একটি ফিল্ড ট্রিপে নিয়ে যাওয়া হবে। এতিমখানার স্টাফরা আসলেই তাকে বিশ্বাস করেছিল, নাকি বাচ্চাদের নিয়তিতে সামনে কী ভয়াবহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছিল সেটা অনুমান করতে পেরে তাঁর সাথে বাচ্চাগুলোকে যেতে দিয়েছিল, সেটা অবশ্য রহস্যই থেকে যাবে। কিন্তু যে সাহসিকতা এবং নিজের জীবন বাজি রেখে সেই এতিমখানা থেকে তিন তিনবার করে বাচ্চাদেরকে সুইস বর্ডারে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, তা আসলেই অসাধারণ এবং বীরত্বের শামিল।

চার্লি চ্যাপলিন; Image Source: thefamouspeople.com
কিন্তু একজনের পক্ষে এতজন বাচ্চাকে শান্ত রাখা কীভাবে সম্ভব! কিন্তু তখনই মারচু তাঁর গোপন অস্ত্র মূকাভিনয়কে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর জাদুকরী মূকাভিনয়ের মাধ্যমে বাচ্চাদের নিয়ে গিয়েছিলেন কল্পনার জগতে। এবং তিনবারই তাঁর এই জাদুকরী মাইম বাচ্চাদেরকে শান্ত রাখতে কাজে দিয়েছিল।
তখনকার সময়ে মারচুর একজন সহযোদ্ধার ছেলে ফিলিপ মোরা ২০০৯ সালে সানডে মর্নিংকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, "পালিয়ে যাওয়ার সময় বাচ্চাদেরকে শান্ত রাখার জন্য মারচু মূকাভিনয় করতে শুরু করেছিল। না, সেটা কোনো অনুষ্ঠান ছিল না। তিনি তাঁর জীবনের জন্য এবং শত শত জীবনের জন্য সেদিন মূকাভিনয় করেছিলেন।"
মারচুর চাচাতো ভাই জর্জ লঞ্জারও স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, "এই এতিমখানায় মারচু আগে থেকেই মূকাভিনয় প্রদর্শন করতো। সেখানে তিনি মাইম প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করতেন। সেখানকার বাচ্চাদের মধ্যে সে এমন একটা আবহ তৈরি করতে পেরেছিল যেন তারা সুইস বর্ডারের কাছাকাছি একটি স্থানে ছুটি কাটাতে যাচ্ছে। মারচু তাদেরকে তাঁর মনোমুগ্ধকর মাইম দিয়ে তাদেরকে একটা স্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।"

১৯৫০ সালে মার্শাল মারচু; Image Source: Abraham Pisarek/ullstein bild/Getty Images
তবে জার্মানদের বিপক্ষে মার্শাল মারচুর অভিযান নিয়ে একটি কল্পকাহিনী প্রচলিত ছিল। এই কল্পকাহিনী অনুসারে, মারচু জার্মান ইউনিট থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে এমনভাবে মাইম প্রদর্শন করেছিলেন যে, জার্মানরা ভেবেছিল একটি বিশাল ফরাসী বাহিনী তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। যদিও পরবর্তীতে মারচু এবং লঞ্জার এই কল্পকাহিনীর সত্যতা নেই বলে জানিয়েছিলেন।
যুদ্ধের পর তরুণ মারচুকে জার্মানির বার্লিনে প্রায় ৩,০০০ মার্কিন সৈন্যের সামনে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল, যেখানে তিনি তাঁর জাদুকরী মূকাভিনয় প্রদর্শন করেছিলেন। ২০০১ সালে মারচুকে যুদ্ধক্ষেত্রে দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনার জন্য মেডেল দিয়ে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছিল এবং সেই অনুষ্ঠানে তিনি যুদ্ধকালীন সময়ের কথা স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, "আমি জিআইএস এর হয়ে মূকাভিনয় করেছিলাম, ঠিক এর দুই দিন পর স্টার অ্যান্ড স্ট্রাইপস থেকে আমার ডাক আসে।"

শেষ বয়সে মার্শাল মারচু; Image Source: thevintagenews.com
শত্রুদের বিপক্ষে ফরাসি প্রতিরোধ অভিযানে মার্শাল মারচুর অবদান কখনোই ভুলে যাওয়া সম্ভব না। এবং যুদ্ধের সময় আইসভিচে তাঁর বাবার মৃত্যুতে যে অকল্পনীয় শোক তিনি বহন করেছিলেন,সেই বিষণ্ণতা পরবর্তীতে তাঁর মূকাভিনয়ে প্রবলভাবে ফুটে উঠেছিল। ২০০৭ সালে কিংবদন্তী এই মূকাভিনেতা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।