
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মির হয়ে যুদ্ধের আকাশ দাপিয়ে বেড়ানো ফাইটার এয়ারক্রাফটগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল কেআই-২৭, কেআই-৪৩ হায়াবুসা, কেই-৪৪ শোকি’র মতো বিখ্যাত যুদ্ধ বিমানগুলো। জাপানের আত্মঘাতী কামিকাজে মিশনে ব্যবহার করা হয়েছিল কেই-৪৩ ফাইটারের একটি সংস্করণও। আকাশ যুদ্ধে জাপানের অন্যতম ভরসার এই ফাইটার বিমানগুলোর নির্মাতা কোম্পানিটির নাম নাকাজিমা।
নাকাজিমার উত্থানে ইম্পেরিয়াল আর্মির বড় ভূমিকা ছিল, একইসাথে বলতে গেলে, শেষপর্যন্ত কোম্পানিটির পতনেও ছিল জাপানিজ ইম্পেরিয়াল আর্মির পরোক্ষ ভূমিকা। উড়োজাহাজ আবিষ্কারের বছরখানেক পরে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটি প্রযুক্তি ও প্রকৌশলের সমন্বয়ে দ্রুতই উন্নতির শিখরে উঠতে থাকে এবং শেষপর্যন্ত হয়ে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। ৩০ বছরেরও কম সময়ে, কোম্পানিটি তৈরি করেছিল কয়েক হাজারের বেশি বিমান এবং এর মধ্যে সর্বমোট ২৫,৯৩৫ বিমানের কাঠামো ও ৪৬,৭২৬টি বিমানের ইঞ্জিনও ছিল। নাকাজিমা কোম্পানিটির উত্থান-পতনের ইতিহাস যা-ই হোক, জাপানের শিল্প জগতে বড় রকমের পরিবর্তনে তা বড় ভূমিকা রেখেছিল।
কেআই-৮৪, তৎকালীন সময়ের অন্যতম সেরা ফাইটার; Image Source: airwar.ru
কোম্পানিটির ক্রমাগত ব্যর্থতা তখন শহরে সবার মুখে মখে এবং ব্যঙ্গাত্মক একটি কথাও প্রচলিত ছিল, “অনেক বেশি কাগজের মুদ্রা, চালের দামও উর্ধ্বমুখী। নাকাজিমা বিমানগুলো বাদে, সবকিছুই উর্ধ্বমুখী।" নাকাজিমা টাইপ-৪ ছিল এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম সফল বিমান, যা সফলভাবে উড়তে ও অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯১৯ সালে টোকিও ও ওসাকার মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি প্রতিযোগিতায় প্রায় ৩ ঘণ্টা ১৮ মিনিট আকাশে উড়ে ৯,৫০০ ইয়েন পুরষ্কার জিতে নেয় টাইপ-৪ এবং জাপানের আমদানিকৃত ভিনদেশি বিমানগুলোও পরাজিত হয় এর কাছে। বিমান সংক্রান্ত প্রযুক্তি ও তথ্য সম্বন্ধে আরও বিশদ জ্ঞানার্জনের জন্য ১৯২০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠানটি কিইহেই নাকাজিমাকে ফ্রান্সে পাঠায়, দীর্ঘ সময় ফ্রান্সে অবস্থান করে ইউরোপের প্রযুক্তি সাথে পরিচিত হয়ে আসেন তিনি। নাকাজিমা কোম্পানিটির দ্রুত প্রসারে তাদের এই কৌশলটি বড় রকমের ভূমিকা রেখেছিল।

কেআই-২৭; Image Source: mission4today.com
একই সময়ে, জাপানের নৌ বাহিনীর জন্যও উন্নত ফাইটার বিমান তৈরি করার কাজ এগিয়ে নিতে থাকে তারা। বিদেশি ফাইটারগুলোকে সরিয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র বিমান তৈরিতে দ্রুত অগ্রগতির মুখ দেখে নাকাজিমা এবং তারা নৌ বাহিনীর জন্য স্বতন্ত্র এনওয়াই নেভি ফাইটার নামে একটি ফাইটার তৈরি করে, যার ইঞ্জিন ছিল জুপিটার ৭। পরবর্তীতে অবশ্য নিজেদের তৈরি আরও উন্নত ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় বিমানটিতে এবং ১৯৩২ সাল নাগাদ সম্পূর্ণ হয় এই বিমানটির সামগ্রিক কাজ। দারুণ পার্ফরম্যান্সের দরুন জাপানিজ আর্মি বিমানটিকে তাদের টাইপ ৯০ ক্যারিয়ার ফাইটার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। এই বিমানটি নিয়ে ‘জেন্ডা সার্কাস’ নামের বিখ্যাত অ্যারোবেটিকস পার্ফরম্যান্সের পর আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি কোম্পানিটিকে। জাপানের নৌ ও সেনাবাহিনীতে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এরপর থেকে এবং ব্যবসা ক্রমেই প্রসারিত হয়।

টাইপ ৯১; Image Source: wikimedia.org
অভিজ্ঞতা ও প্রকৌশল বিদ্যার চর্চার কল্যাণে ১৯৩০ সালের মধ্যে নিজস্ব প্রযুক্তির ইঞ্জিন তৈরি করতে সক্ষম হয় প্রতিষ্ঠানটি এবং টাইপ ৯০ ক্যারিয়ার বিমানে তা প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয়। নৌ বাহিনীর নির্দেশনায় তৈরি ইঞ্জিনগুলো পরবর্তীতে জাপানিজ আর্মিও তাদের টাইপ ৯৭ ফাইটার বিমানে ব্যবহার শুরু করে। সৌভাগ্য বয়ে আনবে বিশ্বাস থেকে ইঞ্জিনের নামকরণে তারা ব্যবহার করত একটি করে জাপানিজ বর্ণমালা। নাকাজিমা ইঞ্জিনগুলো শুধুমাত্র যুদ্ধবিমানেই ব্যবহার করা হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া নাগাদ তারা প্রায় ৭০০০ ইঞ্জিন বেসামরিক উদ্দেশ্যেও তৈরি করেছিল। সময়ের প্রয়োজনে ধীরে ধীরে কোম্পানিটির ইঞ্জিনও আরও উন্নত হতে থাকে এবং এগুলো ব্যবহৃত হতে থাকে তাদের তৈরি বিভিন্ন সামরিক বিমানে।
সামরিক খাতে চাহিদা বেশি থাকায় মুসাশিনো ফ্যাক্টরিটি ব্যবহার করা হত শুধুমাত্র আর্মির জন্য ইঞ্জিন উৎপাদনের কাজে এবং আধুনিক এই ফ্যাক্টরিটি ছিল প্রায় ৬,৬০,০০০ বর্গ মিটারের। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিজ্ঞান সম্মত কৌশলের পাশাপাশি সুচারুভাবে ফ্যাক্টরিটি পরিচালনা করতেন ইচিরো সাকুমা। কর্মচারীদের দারুণ সব সুবিধা দিয়ে সবসময় চাঙ্গা রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি এবং তার দেওয়া সুযোগ সুবিধা তখন পুরো জাপানে অনন্য। পরবর্তীতে, এই কারখানার কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে নৌবাহিনীও অনুরোধ করে শুধুমাত্র তাদের জন্য এরকম একটি ফ্যাক্টরি তৈরি করতে।

টাইপ ৯৭, নাকাজিমার তৈরি অন্যতম সেরা ফাইটার বিমান; Image Source: pacificeagles.net
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই, নাকাজিমা কোম্পানির ওপর আরও আধুনিক ও কার্যকর বিমান তৈরির চাপ বাড়তে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় তারা জাপানিজ আর্মি ও নৌ বাহিনীর জন্য তৈরি করতে থাকে বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ বিমান, যেগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জুড়ে আকাশপথ দাপিয়ে বেড়িয়েছে। টাইপ ৯৭ ফাইটারের পরে জাপানিজ আর্মির জন্য তৈরি করা করা হয় কেআই-৪৩ হায়াবুসা। অসাধারণ ম্যানুভার্যাবিলিটি ও অধিক দূরত্ব পাড়ি দিতে সক্ষম হওয়ায় বিমানটিকে লুফে নেয় জাপানের সামরিক বাহিনী। ৫,৭৫১টি হায়বুসা তৈরি করা হয়েছিল তৎকালীন সময়ে, যা জিরো ফাইটারের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল। তবে হায়াবুসার বিভিন্ন সমস্যা ছিল এবং ডগ ফাইটে এটি যুদ্ধে তেমন একটা সুবিধা করতে পারছিল না। তাই সমসাময়িক সময়েই, এই বিমানের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে আরও উন্নত ফাইটার তৈরি করে নাকাজিমা, বিমানটির নাম দেওয়া হয় কেআই-৪৪ শোকি। শোকি অর্থ, ‘জাপানিজ ডিফেন্স গড’। তবে, অধিক উচ্চতায় বাজে পার্ফরম্যান্স এবং অপেক্ষাকৃত কম গতির হওয়ায় আর্মি তেমন একটা সন্তুষ্ট ছিল না। তারা চাইছিল কেআই-৪৩ ও কেআই-৪৪ ফাইটারের চেয়েও আরও উন্নত ও দ্রুতগতির বিমান।

নাকাজিমা কেআই-৪৩; Image Source: seascansurvey.com

কেআই-৪৪; Image Source: pacificeagles.net
মাত্র ৩০ বছরেরও কম সময়ে, জাপানের বিমান শিল্পে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দিয়েছিল নাকাজিমা এয়ারক্রাফট ইন্ডাস্ট্রি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জাপানের ধ্বংসযজ্ঞে যেমন বড় ভূমিকা রেখেছিল তাদের তৈরি ফাইটার বিমানগুলো, তেমনই এই যুদ্ধে জাপানের পরাজয়েই শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যায় জাপানের অন্যতম পুরনো এই বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি।