বাংলাদেশে হার্ট রিংয়ের নতুন দাম নির্ধারণ নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। সরকার সব ধরনের রিংয়ের দাম কমিয়ে দিয়েছে, যার প্রতিবাদে অনেক ব্যবসায়ী রিং বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বাংলাদেশে হার্টের চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি হচ্ছে স্টেন্ট বা রিং পরানো। কারো হৃদপিন্ডে রক্ত সঞ্চালনে ব্লক বা বাধার সৃষ্টি হলে ডাক্তার তাকে এক বা একাধিক রিং পরানোর পরামর্শ দিতে পারেন।
সেই রিংটা বাংলাদেশে আসে বিদেশ থেকে। সাধারণত ইউরোপ-আমেরিকা থেকে এগুলো আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা। যার মূল্য তালিকা বিভিন্ন হাসপাতালে টানানো থাকে। রোগীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ তালিকা থেকে বেছে নেয়া রিং রোগীর হার্টে প্রতিস্থাপন করেন ডাক্তাররা।
তবে শনিবার থেকে বদলে যাচ্ছে সেই মূল্য তালিকা। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর হার্টের রিং-এর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য সংক্রান্ত নতুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। যাতে সব ধরনের রিংয়ে আগের মূল্যের তুলনায় সর্বনিম্ন ১৩ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৪১ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম কমানো হয়েছে। আর এটি ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকরের কথা বলেছে সরকার। কিন্তু এই নতুন দাম নিয়ে আপত্তি দেখা দিয়েছে আমদানিকারক ও সরবরাহকারীদের একটা অংশে।
মূল্য নতুন করে সমন্বয় না করা পর্যন্ত স্টেন্ট সরবরাহ ও বিক্রি বন্ধ রাখার কথা বলছেন তারা।
নতুন মূল্য তালিকায় কী আছে?
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহা-পরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বিবিসিকে জানান, একটা কমিটির মাধ্যমে অনেক দিন ধরে আলোচনা করে, সবার সাথে কথা বলে নতুন মূল্য তালিকা দেয়া হয়েছে।
ইউসুফ বলেন, ‘সবগুলোর দাম কমেছে আগের চেয়ে। আমরা প্রথমে ১৫ থেকে ২০ দিন আগে আমেরিকান রিংয়ের দাম কমাই, এখন ইউরোপেরটা কমানো হলো। সাধারণত যে রিং সবাই নেয়, যার দাম আগে ৮০ হাজার ছিল ওটা এখন ৬০ থেকে ৬২ হাজারে নেমে এসেছে।’
তিনি মনে করেন, এতে করে বাংলাদেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ রোগী বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায় ওই সংখ্যাটা কমবে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কর্মকর্তা, কার্ডিওলজিস্ট, বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবাইকে নিয়ে গঠিত কমিটি এই নতুন দাম নির্ধারণ করেছে। তবে এর আগে ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে কমিটি। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যেমন জার্মানি, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস ও আয়ারল্যান্ড থেকে রিং আসে। এছাড়া জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারত থেকেও রিং আমদানি করা হয়।
বিভিন্ন পক্ষের সাথে কথা বলে জানা যায়, পাশের দেশ ভারত বা নেপালের তুলনায় বাংলাদেশে রিংয়ের মূল্য বহুগুণ বেশি ছিল এতদিন ফলে অনেক রোগীই কম খরচে ভারতে চিকিৎসা করাতে যেত।
নতুন মূল্য তালিকায় দেখা যায়, এই রিংগুলো আমদানি করতে অনুমতি পেয়েছে ২৭টা কোম্পানি। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের রিংয়ের দাম ধরা আছে ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। আর অন্যান্য রিংয়ের মূল্য সর্বনিম্ন ১৪ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আয়ারল্যান্ডের রিং আছে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত।
তবে প্রতিটি দেশের রিংয়েই আলাদা আলাদা ক্যাটাগরিতে ভাগ করা থাকে। আর ক্যাটাগরি অনুযায়ী দাম ওঠা-নামা করে।
ডাক্তার কোনো রোগীকে রিং বসানোর পরামর্শ দিলে রোগীর পক্ষ থেকে পছন্দ মতো দামের রিং চূড়ান্ত করা হয়। যার অর্ডার নেয় ভেন্ডর বা হাসপাতালের সাথে যুক্ত কোম্পানি এবং তারাই সেটা হাসপাতালে সরবরাহ করে।
রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মাসুম সিরাজ বলেন, ‘আমাদের দেশে এতদিন যে দাম নির্ধারণ ছিল সেটা ভারত-নেপালের চেয়ে অনেক বেশি। একই স্টেন্ট সেসব দেশে অনেক কমে বিক্রি হয়। আমি মনে করি সরকার একটা দারুণ কাজ করেছে।’
এই চিকিৎসক মনে করেন এরপরও লাভ থাকবে ব্যবসায়ীদের।
মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, মূলত ভারতের সমন্বয় করে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। যেটা ওইখানে ৬০০ ডলার, সেটা এখানে ৭৮০ ডলারে বিক্রি হচ্ছিল। আমরা সেটা সমান করে দিয়েছি।’
ড. সিরাজও মনে করেন, এতে করে এখন রোগীরা দেশেই চিকিৎসা করাতে উৎসাহ পাবেন।
ইউরোপ বনাম আমেরিকা
বাংলাদেশে রিং আমদানিকারকদের দু’টি আলাদা দল আছে। একদিকে অল্প কিছু কোম্পানি যারা যুক্তরাষ্ট্রের রিং আমদানি করে। অন্যদিকে, আছে মূলত ইউরোপ ও অন্যান্য দেশের রিং আমদানিকারকরা।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের বেঁধে দেয়া নতুন দামের পর এখন এক রকম মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছে এই দুই পক্ষ।
দাম নির্ধারণের একটা মার্কআপ ফর্মুলা আছে সরকারের। ফর্মুলা অনুযায়ী রিংয়ের কেনা মূল্যের চেয়ে ৪৩% বেশি রেখে দাম ঠিক করে দেয়া হয়। যার মধ্যে থাকে আমদানি খরচ, মার্কেটিং, ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ ও প্রফিট।
এ বিষয়ে আমদানিকারকরা অভিযোগ করছেন, এর মাঝে সরকার সেটা কারো সাথে আলোচনা না করেই কমিয়ে দিয়েছে।
এরপর মাঝে ডলারের বিনিময় মূল্য অনেক বেড়ে গেলে তিনটি কোম্পানি যারা যুক্তরাষ্ট্রের রিং নিয়ে আসে, তারা গিয়ে একটা আবেদন জানায় দাম বাড়ানোর। গত জুনে সেই বাড়তি দামও কার্যকর হয়। কিন্তু এরপর গত মাসে সেই দামটা আবারো কমিয়ে আনে ওষুধ প্রশাসন।
রিংয়ের বাজারজাতকরণ ও সরবরাহ নিয়ে কাজ করা হারুণ উর রশীদ এ বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, একইসাথে এখন কমানো হলো ইউরোপিয়ান রিংয়েরও দাম। আর এটা নিয়ে তাদের সাথে কোনো আলোচনাই করা হয়নি।
রশীদ বলেন, ‘আমাদের উপর দামটা চাপিয়ে দিয়েছে। আমরা ইমপোর্ট করি, দাম নির্ভর করে মূল কোম্পানি উপর। হঠাৎ কয়েকটা কোম্পানি আবেদন করে দাম বাড়িয়ে নিল। এখন তাদেরটা কমাতে গিয়ে সবারটা কমিয়ে দিল।
এক্ষেত্রে তার অভিযোগ, অধিদফতর মার্কআপ ফর্মুলাও মানেনি।
আমেরিকান রিং আমদানি করা ভাসটেক লিমিটেডের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনও বিষয়টি স্বীকার করলেন। তার কথায়, ‘ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কিন্তু সবার সাথে আলাদা আলাদা করে বসার কথা। আমরা যেহেতু বসেছি এবং প্রাথমিক দামটা মেনে নিয়েছি এখন তাদেরও বসতে হবে।
তবে আনোয়ার হোসেন জানান, তারা যে মূল্য দাবি করেছিলেন তার চেয়েও কম মূল্য নির্ধারণ করেছে সরকার।
অন্যদিকে, নতুন করে দাম সমন্বয় না হওয়া পর্যন্ত রিং বিক্রি ও সরবরাহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানান ইউরোপিয়ান রিং আমদানিকারকরা।
এপিক টেকনোলজিসের কর্ণধার ওয়াসিম আহমেদ বলছিলেন, ‘আমরা সবাইকে অনুরোধ করছি এখন রিং ব্যবহার না করার জন্য। আমরা সরিয়ে নেইনি বা হুমকি দিচ্ছি না, শুধু যে বৈষম্য হচ্ছে সেটার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ব্যবহার না করার কথা বলছি। আমরা হয়তো লস করে ১-২টা দিতে পারবো, কিন্তু ৪০০ থেকে ৫০০ তো পারবো না।’
তিনি দাবি করেন বাংলাদেশে চাহিদার ৩৫ শতাংশ রিং আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, বাকি ৬৫ শতাংশের যোগান দেয় অন্যান্য দেশ। আর তাদের অভিযোগ বাংলাদেশে আমেরিকান রিংয়ের নামে যেগুলো পাওয়া এসবই আসলে আমেরিকার বাইরেই তৈরি করা হয়।
আহমেদ মনে করছেন, এখন তড়িঘড়ি করে সরকারের দাম নির্ধারণ করে দেয়া তাদের আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলবে।
ওয়াসিম আহমেদ বলছিলেন, ‘১২ তারিখে তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৬ তারিখে জানিয়ে দিল। এখন আমাদের হাতে এরই মধ্যে অনেক প্রডাক্ট, এত ক্ষতি মানা আমাদের জন্য কঠিন।’
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সাথে দ্রুত আলোচনায় বসতে চান তারা। তাদের দাবি ভারতের দামের সাথে মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ও ইউরোপের রিংয়ের একই রকম মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হোক।
‘হিডেন কস্ট’ বা লুকানো খরচ
সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে রিংয়ের দাম বেশি হওয়ার পেছনে বেশ কিছু ‘হিডেন কস্ট’ আছে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট ইমপোর্টাস অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের কনভেনার আরশেদ আলম প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে রিংয়ের দাম বেশি হওয়ার পেছনে তিনটি কারণ তুলে আনেন। ‘বাংলাদেশে ডিউটি অনেক, এত ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে এনে কত লাভ করবো?’
তিনি বলেন, ‘ভারতে কিন্তু এত ডিউটি নেই, এটা একটা বিষয়। আবার সেখানে চাহিদাও অনেক, একটা কোম্পানি হয়তো সেখানে বছরে কয়েক লাখ প্রডাক্ট আনছে, কিন্তু আমাদের দেশে বছরে হাজার পিসও লাগছে না। ফলে দামও আলাদা। আর আরেকটা আছে ডাক্তারদের পেছনে খরচ।’ দাম বাড়ানোর এই তৃতীয় কারণটা নিয়ে বেশ বিতর্ক দেখা যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ জানান, ‘কার্ডিওলজিস্টরা প্রায় প্রতি মাসে বিদেশ ভ্রমণ যাচ্ছে, এটা কিভাবে সম্ভব? দরকার নেই তাও কনফারেন্সে যাচ্ছেন। যে কোম্পানি যে ডাক্তারকে যেভাবে খুশি করে সেইটা আসলে সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে।’
তবে হারুণ উর রশীদ মনে করেন, ডাক্তারদের বিদেশ যাওয়ার দরকার আছে। আর এইটার স্পন্সরশিপ খরচ তাদের দামের মধ্যেই ধরা থাকে।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই তারা আরো বেশি বিশেষজ্ঞ হোক, সারা বিশ্বে নতুন নতুন প্রোগ্রাম হচ্ছে, প্রযুক্তি আসছে, কনফারেন্সে গিয়ে ডাক্তাররা এগুলো জানতে পারেন।’ বরং সরকার ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ যে ভ্যাট-ট্যাক্স কাটে, সেটা নিয়ে আপত্তি তার।
আরশেদ মনে করেন, এই বিভিন্ন রকম ‘হিডেন কস্ট’ বা লুকানো খরচ বন্ধ করতে পারলে দাম এমনিতেই কমে যাবে।
তিনি জানান, ‘বর্তমান দামেও লাভ থাকার কথা। কিন্তু এসব হিডেন কস্ট তো দেখতে হবে। এসবেই বড় অর্থ চলে যায়। এসব বন্ধ করলে প্রডাক্টের দামও অনেক কমে যাবে।